মাটির আবার কান্না! মাটি কি কাঁদতে পারে? কিভাবে কাঁদে? মাটি যদি কাঁদেই তার আওয়াজ শোনা যায় না কেন? বাস্তবতা হলো, সে কান্না সবাই শুনতে পাবেন না। এ কেবল একজন কৃষি বিজ্ঞানীই বুঝতে পারেন, কান্নার আওয়াজ তিনি সরাসরি শুনতে না পেলেও তা বুঝতে তার কোনো কষ্টই হয় না। প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র গাছের জীবন ও অনুভূতি নিয়ে গবেষণার মধ্য দিয়ে এবং যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। যে মাটি গাছের জন্ম, ধারণ, বন্ধন সব কিছুই সম্পাদন করে, সে মাটিরই তো জীবন, জীবন শক্তি উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, ক্ষয়িষ্ণু নিয়েই একজন মৃত্তিকা বিজ্ঞানীকে গভীরভাবে ভাবতে হয়। কারণ তার সব কর্মকা- তো আবর্তিত হয় এ মাটি যার মাটিতে ধারণকৃত সব জীবন্ত ফসল, লতাগুল্ম; ফলজ, ভেষজ, বনজ বৃক্ষরাজি নিয়েই। সবাই তা যথাযথভাবে বুঝতে না পারলেও কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটির দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আর্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। মাটির বুকে ধারণকৃত গাছে পরিস্ফুট হওয়া নানা ধরনের অস্বাভাবিক বিবর্ণতা অবলোকন করে কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটির নানাবিধ সমস্যাজনিত সৃষ্ট পরিবর্তনগুলো দেখে মাটির কষ্টের কারণগুলো চিহ্নিত করতে এবং প্রতিকার ব্যবস্থা বলে দিতে পারেন অনায়াসেই।
এখন তা হলে দেখা যাক, মাটির কষ্টজনিত বেদনার বহিঃপ্রকাশ কতভাবে হয়, কিভাবে হয় এবং কিভাবেই বা কৃষি বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা দেয়, অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং তা পরিমাপই বা করে কিভাবে? মাটির কান্না এবং তার বহিঃপ্রকাশের প্রকার প্রকৃতি উদ্ঘাটন করতে গেলে মাটির কষ্ট সৃষ্ঠকারী কারণগুলোর পর্যালোচনা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে নানা প্রজাতির ফসল ও গাছের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মতো পুষ্টি উপাদান প্রকৃতিই মাটিকে দিয়ে দিয়েছে। মাটির প্রকৃতি ভেঙে এসব উপাদানের তারতম্য অবশ্যই থাকবে। মানুষের দায়িত্ব বিজ্ঞানসম্মত কৃষি কর্মের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করা। কিন্তু মানুষ নিয়তই এ লক্ষ্য অর্জনের বিপরীতে ধাবমান হয়। তার লক্ষ্য একটিই এবং সেটি হলো যে কোনো উপায়ে মাটি থেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় আর্থিক সুবিধা অর্জন। এ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে চলমান আছে। প্রকৃত প্রদত্ত মাটির নানা পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি মাটিতে আরও থাকে অসংখ্য অনুজীব (সয়েল মাইক্রোবস) এবং মাটির জৈব উপদান (অরগ্যানিক ম্যাটার কনটেন্টে) থাকে।
এদেরকে মাটির মৌলিক জীবনশক্তির জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে মাটিতে আরও থাকে প্রয়োজনীয় সব মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট। মানব দেহে যেমন ইলেট্রেলাইট ইমব্যালেন্স হলে জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি মাটির জৈব উপাদান, অনুজীবের সংখ্যা এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পরিমিত পরিমাণের নিচে নেমে গেলে মাটির উৎপাদনশীলতাও ক্রমান্বয়ে নি¤œমুখী হতে থাকে। আমাদের দেশের মাটির বর্তমান স্বাস্থ্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আছে। অনেকেই বলেন যে, আমাদের মাটি অত্যন্ত উর্বর। যে কোনো ফসল ও গাছ-গাছালি এ মাটিতে রোপণ করলে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে এবং ফলফলাদি দিতে থাকে। এ কথাটি এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর বাস্তবসম্মত নয়। যে মাটি প্রতি বছর বন্যা প্লাবিত হয় সে মাটি ছাড়া অন্য সব মাটি এরই মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারা দেশের মাটির প্রায় ৭০ শতাংশতেই মাটির প্রধান জীবনী শক্তি জৈব উপাদানের পরিমাণ ১ শতাংশ বা তারও নিচে নেমে এসেছে, যা থাকা উচিত কম পক্ষে ২ শতাংশ ।
মাটি পরীক্ষায় মাটির জৈব উপাদান সংক্রান্ত এ তথ্য পাওয়া গেলেও বর্তমান ফসল উৎপাদান প্রক্রিয়া পরিচর্যা এবং চাষাবাদ পদ্ধতির আওতায় মাটিতে অবস্থানরত অনুজীবের পরিবর্তিত অবস্থা এবং মাটির মাইনোনিউট্রিয়েন্ট সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দেশের অধিকাংশ জমির মাটিতে এ দুটো উপাদানের ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ করে নানা প্রকার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ক্রমবর্ধমান, চাহিদা মেটানোর জন্য এর ব্যবহার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে। অথচ বহু কৃষি বিজ্ঞানী একমত পোষণ করেন যে, মাটিতে পরিমিত পরিমাণ জৈব উপদান এবং অনুজীব থাকলে মাটিতে বহুমাত্রিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া চলমান থাকে এবং মাটিতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ভারসাম্য সংরক্ষিত হয়। মৃত্তিকা গবেষণায় এসব বিষয়াদি নিয়ে আরও সযতœ গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। মাটির মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি রাসায়নিক পর্দাথ দিয়ে পূরণ না ঘাটতি করে মাটির প্রাকৃতিক মাটইক্রোনিউট্রিয়েশনের সংরক্ষণ করা যায় সেই গবেষণা জোরদার করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মানব দেহে ‘ভিটামিন’ ও ‘মিনারালস’ যে কাজ করে মাটিতেও ‘মাইট্রোনিউট্রিয়েট’ একই কাজ করে। ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও এ দেশের আবাদি জমি বিশেষ করে বন্যাপ্লাবিত হয় না এবং সেচ সুবিধার আওতায় ও আসেনি এমন সব জমিতে বছরে একটি ফসলের আবাদই হতো। তবে কোথাও কোথাও দুইটি ফসল যে হতো না তা নয়। আবাদি ফসল ওঠার পর জমিগুলো বিশ্রামেই থাকত। এ বিশ্রামের সময়টাতে মাটিতে বয়ে যাওয়া পুষ্টি উপদান এবং প্রকৃতি থেকে পাওয়া পুষ্টি উপাদান স্বযতেœ বুকে ধারণ করে মাটি স্বস্তিতেই কাটাতো।
কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটানোর তাগিদে পানি প্রিয় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের জন্য পানি সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প ছিল না। তাই পানি সেচ সুবিধা সম্প্রসারণের সাথে সাথে সেচ সহজলভ্য এলাকায় একই জমিতে বিরতিহীনভাবে একের পর এক ধানের আবাদ চলতেই থাকে। ফলে এসব জমির মাটির নেই কোনো স্বস্তি, অধিকাংশ সময় বুকে ধারণ করে থাকতে হয় পানি। একই জমিতে একের পর এক ধানের আবাদ করাতে ধানের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ এবং রোগবালাইয়ের আক্রমণ ও ক্রমাগত বেড়েই চলে। সাথে সাথে রাসায়নিক কীট ও বালাইনাশক দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিমাণও যায় বেড়ে। অধিকাংশ এসব রাসায়নিক বিষাক্ত দ্রব্যাদি ফসলের জমিতে ছিটিয়ে ব্যবহার করা হলেও অনেক দিন ধরেই দানাদার বালাইনাশক ফসলের ক্ষেত্রের মাটিতে সরাসরি ব্যবহার ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পরিমাণও নেহায়েত কম নয়। এটাও সরাসরি সবারই জানা আছে যে, ধান গাছ কেবল ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি গভীর থেকে পুষ্টি উপাদান আহরণ করতে পারে। কারণ ধানের শিকড় এর চেয়ে গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে একই জমিতে ধানের আবাদ হতে থাকলে মাটির ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি নিচ দিয়ে একটি কঠিন পাললশীলার ( প্লাত্তপ্যাল) সৃষ্টি হয়, যা ভেদ করে মাটির পুষ্টি উপাদান উপরে উঠে আসতে পারে না, ফলে ধান গাছ তা নিজের পুষ্টির জন্য ব্যবহার করতে পারে না তাই ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে মাটিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের বাড়াতে হয়।
মাটির বহু মাত্রিক যন্ত্রণার মাঝে একটি বিষয় যা আমাদের অনেক কৃষক ভাইরা মনে করেন যে, ধান লাগানোর আগে মাটি যত বেশি মসৃণভাবে কাদা করা যাবে ততই ধানের জন্য ভালো হবে কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। এতে ধানের ভালোর চেয়ে মন্দই হবে বেশি। কারণ এ অবস্থায় মাটির স্বাভাবিক রাসায়নিক বিক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি মাটির বুকে ধান গাছের ধারণ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। সেচ সুবিধা পাওয়া অনেক জমিতে এমন অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্যও এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। একদিকে ধান কাটা হচ্ছে অন্যদিকে সাথে সাথে পেছন পেছন, আবার ধান লাগানোর জন্য কলের লাঙল (পাওয়ার টিলার) চলছে। আর ধানের নাড়াজলে জমি থেকে তুলে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য শুকাতে দিচেছ। এতে জমিকে কোনো অবসর না দিয়ে কালক্ষেপণ না করে একের পর এক আবাদের মাধ্যমে প্রচুর ধান পেয়ে অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে ৩ বেলা পেট ফাটিয়ে ভাত খাচ্ছেন এবং আনন্দ বোধ করছেন। অথচ যে মাটি থেকে এত ধান পাচ্ছেন সেই মাটি প্রতি নিয়ত নানাবিধ যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে ক্রমশ প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে মাটি এতটাই প্রাণহীন হয়ে পড়তে পারে যে তাকে আবার পুনর্জীবিত করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। কাজেই ভিশনসমৃদ্ধ যে কোনো কৃষি বিজ্ঞানী মাটির চলমান উদ্বেগজনক অবস্থা অবলোকন করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বেই। সীমাহীন চাহিদায় উন্মুত্ত মানুষের আকাক্সক্ষা মেটাতে ফসলের ধারক বাহক মাটি কতটুকু ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে তা ভেবে দেখার অবকাশ মানুষের। তাই কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার আকুল আবেদন তারা যেন আর কালক্ষেপণ না করে মাটির হারানো প্রাণশক্তিকে ফিরিয়ে আনার, তাকে আরও সমৃদ্ধ করার এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল উদ্ভাবনে নিয়োজত হন, যাতে ক্রমবদ্ধমান জনগোষ্ঠীর টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
ড. মো. আমীরুল ইসলাম*
* সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট; মোবাইল ০১৭৪৭৫৭০৫৪৪